Sunday, August 26, 2018

সূরা আলবাকারা সর্ম্পকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলিঃ

সূরা সর্ম্পকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলিঃ


 আল বাকারা:

আরবি ভাষায়: (سورة البقرة) মুসলমানদের পবিত্র কুরআনের ২ নম্বর সূরা, এর আয়াত সংখ্যা ২৮৬ টি এবং এর রূকুর সংখ্যা ৪০ টি। আল বাকারা সূরাটি মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছে।

নামকরণ:

বাকারাহ মানে গাভী। এ সূরার ৬৭ থেকে ৭৩ নম্বর আয়াত পর্যন্ত হযরত মুসা (আঃ) এর সময়কার বনি ইসরাইল এর গাভী কুরবানীর ঘটনা উল্লেখ থাকার কারণে এর এই নামকরণ করা হয়েছে। কুরআন মজীদের প্রত্যেকটি সূরার এত ব্যাপক বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে যার ফলে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে তাদের জন্য কোন পরিপূর্ণ ও সার্বিক অর্থবোধক শিরোনাম উদ্ভাবন করা কষ্টকর। শব্দ সম্ভারের দিক দিয়ে আরবি ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ তাই বাংলায় এর সঠিক মানে সবক্ষেত্রে যথেষ্ঠ নয় । এ জন্য নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী কুরআনের অধিকাংশ সূরার জন্য শিরোনামের পরিবর্তে নিছক আলামত ভিত্তিক নাম রেখেছেন। এই সূরার নামকরণ আল বাকারাহ করার অর্থ কেবল এতটুকু যে, এটি এমন সুরা যেখানে গাভীর কথা বলা হয়েছে।

নাযিলের সময়-কাল:

এ সূরার বেশীর ভাগ মদীনায় হিজরাতের পর মাদানী জীবনের একেবারে প্রথম যুগে নাযিল হয়। আর এর কম অংশ পরে নাযিল হয়। বিষয়স্তুর সাথে সামঞ্জস্য ও সাদৃশ্যের সম্পর্কিত যে আয়াতগুলো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে নাযিল হয় সেগুলোও এখানে সংযোজিত করা হয়েছে। যে আয়াতগুলো দিয়ে সূরাটি শেষ করা হয়েছে সেগুলো হিজরাতের আগে মক্কায় নাযিল হয়। কিন্তু বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যের কারণে সেগুলোকেও এ সূরার সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে।

নাযিলের উপলক্ষ্য:

এ সূরাটি বুঝতে হলে প্রথমে এর ঐতিহাসিক পটভূমি ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে।

(১) হিজরাতের আগে ইসলামের দাওয়াতের কাজ চলছিল কেবল মক্কায়। এ সময় পর্যন্ত সম্বোধন করা হচ্ছিল কেবলমাত্র আরবের মুশরিকদেরকে। তাদের কাছে ইসলামের বাণী ছিল সম্পূর্ণ নতুন ও অপরিচিত। এখন হিজরাতের পরে ইহুদিরা সামনে এসে গেল। তাদের জনবসতিগুলো ছিল মদীনার সাথে একেবারে লাগানো। তারা তাওহীদ, রিসালাত, অহী , আখেরাত ও ফেরেশতার স্বীকৃতি দিত। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের নবী মূসা আলাইহিস সালামের ওপর যে শরিয়াতী বিধান নাযিল হয়েছিল তারও স্বীকৃতি দিত। নীতিগতভাবে তারাও সেই দীন ইসলামের অনুসারী ছিল যার শিক্ষা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়ে চলছিলেন। কিন্তু বহু শতাব্দী কালের ক্রমাগত পতন ও অবনতির ফলে তারা আসল দীন থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। তাদের আকীদা-বিশ্বাসের মধ্যে বহু অনৈসলামিক বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। তাওরাতে এর কোন ভিত্তি ছিল না। তাদের কর্মজীবনে এমন অসংখ্য রীতি-পদ্ধতির প্রচলন ঘটেছিল যথার্থ দীনের সাথে যেগুলোর কোন সম্পর্ক ছিল না। তাওরাতের মধ্যে তারা মানুষের কথা মিশিয়ে দিয়েছিল। শাব্দিক বা অর্থগত দিক দিয়ে আল্লাহর কালাম যতটুকু পরিমাণ সংরক্ষিত ছিল তাকেও তারা নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিকৃত করে দিয়েছিল। দীনের যথার্থ প্রাণবস্তু তাদের মধ্য থেকে অন্তরহিত হয়ে গিয়েছিল। লোক দেখানো ধার্মিকতার নিছক একটা নিস্প্রাণ খোলসকে তারা বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল। তাদের উলামা,মাশায়েখ, জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও জনগণ – -সবার আকীদা-বিশ্বাস এবং নৈতিক ও বাস্তব কর্ম জীবন বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের এই বিকৃতির প্রতি তাদের আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌছে দিয়েছিল যার ফলে কোন প্রকার সংস্কার সংশোধন গ্রহণের তারা বিরোধী হয়ে উঠেছিল। যখনই কোন আল্লাহর বান্দা তাদেরকে আল্লাহর দীনের সরল-সোজা পথের সন্ধান দিতে আসতেন তখনই তারা তাঁকে নিজেদের সবচেয়ে বড় দুশমন মনে করে সম্ভাব্য সকল উপায়ে তার সংশোধন প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য উঠে পড়ে লাগতো।
শত শত বছর ধরে ক্রমাগতভাবে এই একই ধারার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলছিল। এরা ছিল আসলে বিকৃত মুসলিম। দীনের মধ্যে বিকৃতি , দীন বহির্ভূত বিষয়গুলোর দীনের মধ্যে অনুপ্রবেশ, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি , দলাদলি , বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাদ দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে মাতামাতি , আল্লাহকে ভুলে যাওয়া ও পার্থিব লোভ-লালসায় আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যাওয়ার কারণে তারা পতনের শেষ প্রান্তে পৌছে গিয়েছিল। এমন কি তারা নিজেদের আসল ‘মুসলিম’নামও ভুলে গিয়েছিল। নিছক ‘ইহুদি’ নামের মধ্যেই তারা নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আল্লাহর দীনকে তারা কেবল ইসরাঈল বংশজাতদের পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত উত্তরাধিকারে পরিণত করেছিল। কাজেই নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় পৌছার পর ইহুদিদেরকে আসল দীনের দিকে আহবান করার জন্য আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিলেন। সূরা বাকারার ১৫ ও ১৬ রুকূ’ এ দাওয়াত সন্বলিত। এ দু’রুকূ’তে যেভাবে ইহুদিদের ইতিহাস এবং তাদের নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার সমালোচনা করা হয়েছে এবং যেভাবে তাদের বিকৃত ধর্ম ও নৈতিকতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের মোকাবিলায় যথার্থ দীনের মূলনীতিগুলো পাশাপাশি উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে আনুষ্ঠানিক ধার্মিকতার মোকাবিলায় যথার্থ ধার্মিকতা কাকে বলে , সত্য ধর্মের মূলনীতিগুলো কি এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে কোন্ কোন্ জিনিস যথার্থ গুরুত্বের অধিকারী তা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এ সময়ের প্রায় ১৯শ ’ বছর আগে হযরত মূসার (আ)যুগ অতীত হয়েছিল। ইসরাঈলী ইতিহাসের হিসেব মতে হযরত মূসা (আ)খৃঃ পূঃ ১২৭২ অব্দে ইন্তিকাল করেন। অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৬১০ খৃস্টাব্দে নবুওয়াত লাভ করেন।

(২) মদীনায় পৌছার পর ইসলামী দাওয়াত একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছিল। মক্কায় তো কেবল দীনের মূলনীতিগুলোর প্রচার এবং দীনের দাওয়াত গ্রহণকারীদের নৈতিক প্রশিক্ষণ দানের মধ্যেই ইসলামী দাওয়াতর কাজ সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু হিজরাতের পর যখন আরবের বিভিন্ন গোত্রর লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে চতুর্দিক থেকে মদীনায় এসে জমায়েত হতে থাকলো এবং আনসারদের সহায়তায় একটি ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্ গড়ে উঠলো তখন মহান আল্লাহ সমাজ, সংস্কৃতি, লোকাঁচার , অর্থনীতি ও আইন সম্পর্কিত মৌলিক বিধান দিতে থাকলেন এবং ইসলামী মূলনীতির ভিত্তিতে এ নতুন জীবন ব্যবস্থাটি কিভাবে গড়ে তুলতে হবে তারও নির্দেশ দিতে থাকলেন। এ সূরার শেষ ২৩টি রুকু’তে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এ নির্দেশ ও বিধানগুলো বয়ান করা হয়েছে। এর অধিকাংশ শুরুতেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং কিছু পাঠানো হয়েছিল পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়োজন অনুযায়ী বিক্ষিপ্তভাবে।

(৩) হিজরাতের পর ইসলাম ও কুফরের সংঘাতও একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছিল। হিজরাতের আগে ইসলামের দাওয়াত কুফরের ঘরের মধ্যেই দেয়া হচ্ছিল। তখন বিভিন্ন গোত্রের যেসব লোক ইলাম গ্রহণ করতো তারা নিজেদের জায়গায় দীনের প্রচার করতো। এর জবাবে তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হতো। কিন্তু হিজরাতের পরে এ বিক্ষিপ্ত মুসলমানরা মদীনায় একত্র হয়ে একটি ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করার পর অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে গেলো। তখন একদিকে ছিল একটি ছোট জনপদ এবং অন্যদিকে সমগ্র আরব ভূখন্ড তাকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। এখন এ ছোট্ট দলটির কেবল সাফল্যই নয় বরং তার অস্তিত্ব ও জীবনই নির্ভর করছিল পাঁচটি জিনিসের ওপর।

এক: পূর্ণ শক্তিতে ও পরিপূর্ণ উৎসাহ-উদ্দীপনা সহকারে নিজের মতবাদের প্রচার করে সর্বাধিক সংখ্যক লোককে নিজের চিন্তা ও আকীদা-বিশ্বাসের অনুযায়ী করার চেষ্টা করা।
দুই: বিরোধীদের বাতিল ও ভ্রান্ত পথের অনুসারী বিষয়টি তাকে এমনভাবে প্রমাণ করতে হবে যেন কোন বুদ্ধি-বিবেকবান ব্যক্তির মনে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও সংশয় না থাকে।
তিন: গৃহহারা ও সারা দেশের মানুষের শত্রুতা ও বিরোধিতার সম্মুখীন হবার কারণে অভাব-অনটন , অনাহার-অর্ধহার এবং সার্বক্ষণিক অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতায় সে ভুগছিল। চতুর্দিকে থেকে বিপদ তাকে ঘিরে নিয়েছিল এ অবস্থায় যেন সে ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে পড়ে। পূর্ণ ধৈর্য ও সহিষ্ণতা সহকারে যেন অবস্থার মোকাবিলা করে এবং নিজের সংকল্পের মধ্যে সামান্যতম দ্বিধা সৃষ্টির সুযোগ না দেয়।
চার: তার দাওয়াতকে ব্যর্থকাম করার জন্য যে কোন দিক থেকে যে কোন সশস্ত্র আক্রমণ আসবে পূর্ণ সাহসিকতার সাথে তার মোকাবিলা করার জন্য তাকে প্রস্তুত হতে হবে। বিরোধী পক্ষের সংখ্যা ও তাদের শক্তির আধিক্যের পরোয়া করা চলবে না।
পাঁচ: তার মধ্যে এমন সুদৃঢ় হিম্মত সৃষ্টি করতে হবে যার ফলে আরবের লোকেরা ইসলাম যে নতুন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তাকে আপসে গ্রহণ করতে না চাইলে বল প্রয়োগে জাহেলিয়াতের বাতিল ব্যবস্থাকে মিটিয়ে দিতে সে একটুকু ইতস্তত করবে না। এ সূরায় আল্লাহ এ পাঁচটি বিষয়ের প্রাথমিক নির্দেশনা দিয়েছেন।

(৪) ইসলামী দাওয়াতের এ পর্যায়ে একটি নতুন গোষ্ঠীও আত্মপ্রকাশ শুরু করেছিল। এটি ছিল মুনাফিক গোষ্ঠী। নবী করীমের (সা)মক্কায় অবস্থান কালের শেষের দিকেই মুনাফিকীর প্রাথমিক আলামতগুলো সুস্পষ্ট হতে শুরু হয়েছিল। তবুও সেখানে কেবল এমন ধরনের মুনাফিক পাওয়া যেতো যারা ইসলামের সত্যতা স্বীকার করতো এবং নিজেদের ঈমানের ঘোষণাও দিতো। কিন্তু এ সত্যের খাতিরে নিজেদের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে নিজেদের পার্থিব সম্পর্কচ্ছেদ করতে এবং এ সত্য মতবাদটি গ্রহণ করার সাথে সাথেই যে সমস্ত বিপদ-আপদ , যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা ও নিপীড়ন –নির্যাতন নেমে আসতে থাকতো তা মাথা পেতে নিতে তারা প্রস্তুত ছিল না। মদীনায় আসার পর এ ধরনের মুনাফিকদের ছাড়াও আরো কয়েক ধরনের মুনাফিক ইসলামী দলে দেখা যেতে লাগলো। মুনাফিকদের এটি গোষ্ঠ ছিল ইসলামকে চুড়ান্তভাবে অস্বীকারকারী। তারা নিছক ফিত্না সৃষ্টি করার জন্য মুসলমানদের দলে প্রবেশ করতো। মুনাফিকদের দ্বিতীয় গোষ্ঠীটির অবস্থা ছিল এই যে, চতুর্দিক থেকে মুসলিম কর্তৃত্ব ও প্রশাসন দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে যাবার কারণে তারা নিজেদের স্বার্থ-সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে একদিকে নিজেদেরকে মুসলমানদের অন্তরভুক্ত করতো এবং অন্যদিকে ইসলাম বিরোধীদের সাথেও সম্পর্ক রাখতো। এভাবে তারা উভয় দিকের লাভের হিস্সা ঝুলিতে রাখতো এবং উভয় দিকের বিপদের ঝাপ্টা থেকেও সংরক্ষিত থাকতো। তৃতীয় গোষ্ঠীতে এমন ধরনের মুনাফিকদের সমাবেশ ঘটেছিল যারা ছিল ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দোদুল্যমান। ইসলামের সত্যতার ব্যাপারে তারা পূর্ণ নিশ্চিন্ত ছিল না। কিন্তু যেহেতু তাদের গোত্রের বা বংশের বেশির ভাগ লোক মুসলমান হয়ে গিয়েছিল তাই তারাও মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। মুনাফিকদের চতুর্থ গোষ্ঠীটিতে এমন সব লোকের সমাবেশ ঘটেছিল যারা ইসলামকে সত্য বলে স্বীকার করে নিয়েছিল কিন্তু জাহেলিয়াতের আচার –আচরণ, কুসংস্কার ও বিশ্বাসগুলো ত্যাগ করতে , নৈতিক বাধ্যবাধকতার শৃংখল গলায় পরে নিতে এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের বোঝা বহন করতে তাদের মন চাইতো না।

সূরা বাকারাহ নাযিলের সময় সবেমাত্র এসব বিভিন্ন ধরনের মুনাফিক গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ শুরু হয়েছিল। তাই মহান আল্লাহ এখানে তাদের প্রতি সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত করেছেন মাত্র। পরবর্তীকালে তাদের চরিত্র ও গতি-প্রকৃতি যতই সুস্পষ্ট হতে থাকলো ততই বিস্তারিতভাবে আল্লাহ তা’আলা বিভিন্ন মুনাফিক গোষ্ঠীর প্রকৃতি অনুযায়ী পরবর্তী সূরাগুলোয় তাদের সম্পর্কে আলাদা আলাদাভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।

সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায়:

সূরা বাকারা একটি মাদানী সূরা, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ(সা) মদিনায় হিজরত এর পরে এই সূরা নাজিল হয়েছিল। আরো বিশেষভাবে বলতে গেলে, এই সূরার বেশীরভাগ অংশই নাজিল হয়েছিল হিজরতের প্রথম দেড় থেকে দুই বছরে। যদিও পুরো সূরাটি নাজিল হতে লেগেছিল ৯ বছর।

মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পরে মুসলিমরা সম্পূর্ন ভিন্ন:

এক - পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। মক্কায় তারা ছিল নির্যাতিত ও সংখ্যাগরিষ্ঠ, আর মদিনায় মুসলিমদের সংখ্যা ছিল বেশী।
দুই - মক্কার জীবনে যেহেতু মুসলিমদের জন্য নিজের ঈমান রক্ষা করে চলাই কষ্টসাধ্য ছিল তাই আল্লাহ্ তখনো খুব বেশী নিয়ম-কানুন জারি করেননি। মদীনায় যেহেতু মুসলিমদের জীবন অনেকটাই শংকামুক্ত, তাই এখানে আসার পরে আল্লাহ্ বিভিন্ন বিধি-বিধান নাজিল করা শুরু করেন, যার বৃহৎ অংশ আছে সূরা বাকারায়।
তিন – মক্কায় যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা সামাজিক সুবিধা পাবার আশায় নয়, বরং শুধু ইসলামকে ভালবেসেই তা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু মদিনায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় অনেকেই মুখে-মুখে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল, কিন্তু অন্তরে ছিল চরম ইসলাম-বিদ্বেষ। এই মুনাফিকদের সম্পর্কেও বলা হয়েছে এই সূরায়।
চার – মদিনায় ইহুদীদের তিনটি বড় গোত্র বাস করত। এই প্রথমবারের মতো মুসলিমরা যেহেতু ইহুদিদের সংস্পর্শে আসছে, কাজেই তাদের সাথে কিভাবে ব্যবহার ও লেন-দেন করতে হবে তা-ও বলা হয়েছে এই সূরায়।
পাঁচ – এই সূরায় আদম(আ) ও ইবলিশের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে কারণ এতে মুসলিমদের জন্য শিক্ষনীয় অনেক কিছু আছে। আর বলা হয়েছে মুসা(আ) ও বনী ইসরাইলের কাহিনী কারণ তাদের বংশধরেরাই হলো ইহুদিরা। মুসা(আ) এর যে ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে তার মূলে আছে একটি বকনা-বাছুর (young female cow), ইহুদিরা যাকে পূজা করেছিল আল্লাহকে বাদ দিয়ে। এই ঘটনার কারণেই এই সূরার নামকরণ করা হয়েছে বাকারা বা বকনা-বাছুর।

নামকরনের ঘটনা:

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা তাদের একটি গরু জবাই করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মাত্র, তারা একটি যে কোনো প্রকারের গরু জবাই করলেই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তারা অপ্রয়োজনীয় ও বেহুদা কথা বলেছিল তাতে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হতে হয়েছিল, যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ বনি ইসরাইলের গরুর ঘটনা।সূরা বাকারার ৬৭ হতে ৭৩নং আয়াত পর্যন্ত গরুর কাহিনী সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে।কোরআনসহ বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত কাহিনীগুলো নিচে উল্লেখ করা হল:

ঘটনা-১: 
বনি ইসরাইলে আমিল নামক এক ধনী ব্যক্তি ছিল। তার এক ভাতিজা ব্যতীত আর কোনো ওয়ারিশ ছিল না। চাচার মৃত্যুতে বিলম্ব দেখে ওয়ারেশি সম্পদের লোভে ভাতিজা তার চাচাকে হত্যা করে এবং তার লাশ নিয়ে অন্য গ্রামে ফেলে আসে স্থানীয় লোকেরা তার লাশ দাফন করে। ঘটনাটি ছিল রাতের। পরের দিন ভাতিজা চাচার খুনের দাবিদার হয় এবং মহল্লার কতিপয় লোককে সঙ্গে নিয়ে হজরত মুসা (আ.)-এর নিকট উপস্থিত হয় এবং তার চাচার খুনের দাবি পেশ করে।

ঘটনা-২: 
এক ব্যক্তির এক অতি সুন্দরী স্ত্রী ছিল। তার কোনো আত্মীয় মহিলার প্রতি আকৃষ্ট ছিল এবং তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক ছিল। এ কারণে সে তার স্বামীকে হত্যা করে।

ঘটনা-৩: 
আরেক বর্ণণায় রয়েছে বণী ইসরাইল বংশে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিল। তার ছিল একটি কন্যা সন্তান এবং ছিল একজন দরিদ্র ভাতিজাও। সে চাচার সম্পদের আশায় চাচাতো বোনকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিল। কিন্তু চাচা তার এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। এতে যুবকটি রাগান্বিত হয়ে আল্লাহর শপথ করে বললো, অবশ্যই আমি আমার চাচাকে হত্যা করবো, তার ধন সম্পদ কুক্ষিগত করবো, তার কন্যা সন্তানকে বিবাহ করবো এবং অন্যকে মিথ্যা দোষারোপ করে তার খুনের মূল্য খেয়ে ফেলবো।
অতঃপর যুবকটি তার নিকট আসলো। ইতিমধ্যে বণী ইসরাইল গোত্রে একদল ব্যবসায়ী আগমন করে। ভাতিজা বলল হে চাচা! আমার সঙ্গে চলুন এবং আমার জন্য ঐ সকল ব্যবসায়ীর নিকট থেকে কিছু পণ্য গ্রহণ করুন। আশা করি আমি কিছু পাবো। অবশ্যই তারা যখন আমার সঙ্গে আপনাকে দেখবে তারা আমাকে দান করবে। তখন চাচা নিজ ভাতিজার সাথে রাতের বেলায় গমন করে। অতঃপর বৃদ্ধ লোকটি যখন সেই বংশে পৌঁছলো ভাতিজা তাঁকে হত্যা করে নিজের পরিবারে ফিরে আসে।এবং চাচার হত্যারকারীর প্রশ্ন কে খুজতে থাকেন ও মুসা আ: কাছে সমাধান চান।

অতপর তারা মুসা (আ:) কাছে হত্যার বিচারের জন্য যান। হজরত মুসা (আ.) লোকদের নিকট নিহত ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, সবাই অস্বীকার করে। তাই নিহত ব্যক্তির ব্যাপারটি হজরত মুসা (আ.)-এর নিকট সন্ধিগ্ধ হয়ে পড়ে। লোকেরা হজরত মুসা (আ.)-কে অনুরোধ জানায়, তিনি যেন আল্লাহর দরবারে নিহত ব্যক্তির অবস্থা প্রকাশের জন্য দোয়া করেন। তিনি দোয়া করেন এবং আল্লাহর দরবার হতে নির্দেশ আসে একটি গরু জবাই করার।

বনি ইসরাইল সহজ-সরলভাবে নির্দেশ পালন না করে বারবার নানা প্রশ্ন করে জটিলতার সৃষ্টি করতে থাকে এবং আল্লাহর দরবার হতেও কঠিন শর্ত আরোপ করা হতে থাকে, যার বিবরণ কোরআনে রয়েছে। তবে কিভাবে আল্লাহর নির্দেশিত গরুর সন্ধান লাভ করে তার উল্লেখ না থাকলেও তারা “ইনশাল্লাহ”(আল্লাহ চায়তো) বলেছিল বলে তারা সেই গরু পেয়েছিল এবং তা জবাই করে গরুর অংশ বিশেষ নিহত ব্যক্তির দেহে স্পর্শ করলে সে জীবিত হয়ে বলে দিয়েছিল, তার ভাতিজাই তার হত্যাকারী। হত্যাকারীর কি শাস্তি হয়েছিল কোরআনে তার উল্লেখ নেই। তবে এ ঘটনার প্রেক্ষিতে তওরাতে মিরাসের বিধান অবতীর্ণ হয় বলে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। “ইনশাল্লাহ” বলার ফলে আদিষ্ট গরু পাওয়া যায় বলেও বর্ণনা রয়েছে। আল্লাহ চাইলে এ বাক্যটি যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা উচ্চারণ করেনি আদিষ্ট গরুর সন্ধান তারা পায়নি। তাই যে কোনো ভালো কাজ করার পূর্বে আল্লাহর ওপর ভরসা করা অর্থাৎ ইনশাল্লাহ বলে আরম্ভ করা উচিত। বনি ইসরাইলের এ ঘটনায় তার শিক্ষা রয়েছে।

হত্যাকারী শনাক্তকরণে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী গরু সন্ধানের ঘটনাটি বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়ে থাকে, যার মধ্যে একটি বর্ণনা নিন্মরূপ:

মাতৃভক্ত পুত্রের বিরল সততা:

ঘটনা-১: 
বনি ইসরাইলে একজন ছালেহ বা সৎ ব্যক্তি ছিলেন। তার এক পুত্র ও একটি গরু বাছুর ছিল। একদিন তিনি গরুর বাছুরটি জঙ্গলে নিয়ে যান এবং আল্লাহর দরবারে এই মর্মে প্রার্থনা করেন, হে আল্লাহ! এ বাছুরটি তোমার সফরদ করছি যাতে আমার ছেলে বড় হলে এটি তার কাজে আসে। বাছুরটি জঙ্গলে ছেড়ে আসার কিছুদিনের মধ্যে লোকটির মৃত্যু ঘটে এবং বাছুরটি জঙ্গলে যৌবনে পৌঁছে। বাছুরটির অবস্থা ছিল এই যে, কোনো লোক যদি তার কাছে আসার চেষ্টা করত তাকে দেখামাত্র সে দূরে পালিয়ে যেত। মায়ের অত্যন্ত ভক্ত, অনুগত ও খেদমতগুজার ছেলেটিও বড় হয় এবং যৌবনে পৌঁছে। তার অবস্থা ছিল এই যে, রাতের অংশকে সে তিন ভাগে ভাগ করত, এক ভাগ তার মায়ের সেবাযত্নে কাটাতো, এক ভাগ আল্লাহর এবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতো এবং নিজের আরামে ব্যয় করতো। ভোরে উঠে সে জঙ্গলে গিয়ে কাঠ বা লাকড়ি সংগ্রহ করতো এবং বাজারে নিয়ে গিয়ে তা বিক্রি করতো। বিক্রিলব্ধ অর্থও সে তিন ভাগে ভাগ করতো। এক অংশ দান-সদকা করতো, এক অংশ নিজের খাবারে ব্যয় করতো এবং এক অংশ তার মাকে প্রদান করতো।

ছেলেটির মা একদিন তাকে বলল, তোমার পিতা মিরাছ বা উত্তরাধিকার হিসেবে একটি গরুর বাছুর রেখে যান এবং ওটা আল্লাহর নামে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। অতএব, তুমি সেখানে যাও এবং হজরত ইবরাহীম (আ.), হজরত ইসমাঈল (আ.), হজরত ইসহাক (আ.) এবং হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর প্রভুর নিকট দোয়া করো যেন তিনি ঐ বাছুরকে তোমার সমর্পণ করেন। বাছুরটির পরিচয় হচ্ছে, তুমি যখন তাকে দেখবে তখন তার চামড়া হতে সূর্যের উল্কার ন্যায় আলোক নির্গত হচ্ছে মনে হবে। তার অপূর্ব সৌন্দর্য ও হলদে বর্ণের কারণে সে সোনালি হয়ে গেছে। ছেলেটি তার মায়ের কথা মতো জঙ্গলে গিয়ে বাছুরটিকে দেখতে পায়। সে চিৎকার করে বলল, হে গাভী! হজরত ইবরাহীম (আ.), হজরত ইসমাঈল (আ.), হজরত ইসহাক (আ.) এবং হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর প্রভুর দোহাই দিয়ে আমি তোকে বলছি, তুই আমার নিকট চলে আয়। এ কথা শোনামাত্র গাভী দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। ছেলেটি তার গর্দানে হাত দিয়ে হাকাতে হাকাতে তার গৃহের দিকে চলতে থাকে। আল্লাহর নির্দেশে গাভী বাকশক্তির অধিকারী হয়ে বলে ওঠে, তুমি আমার পিঠে সোয়ার হয়ে যাও, এতে তোমার আরাম হবে, যাত্রা সহজ হবে। ছেলে বলল, আমি এরূপ করবো না। কেননা, আমার মা আমাকে সোয়ার হওয়ার জন্য বলেননি বরং বলেছেন যে, তার ঘাড় ধরে নিয়ে যেতে।  গাভী বলল, ভালোই হলো, তুমি আমার ওপর সোয়ার হলে না। এরূপ হলে আমি কিছুতেই তোমার নিয়ন্ত্রণে আসতাম না। আর তোমার মায়ের সেবা-তাঁবেদারির কারণে তোমার মধ্যে এমন শানমর্যাদার সৃষ্টি হয়েছে। মায়ের প্রতি আনুগত্য, সেবার প্রতি পশুর জবানবন্দি প্রমাণ করে যে, সন্তানের কাছে মায়ের স্থান কত ঊর্ধ্বে থাকা উচিত। তাই ইসলাম ঘোষণা করেছে, আল-জান্নাতু তাহতা আকদামিন ওমমাহাতা অর্থাৎ মায়েদের পদতলে বেহেশত। মায়েদের প্রতি তথা জননীকুলের প্রতি ইসলামপূর্ব বর্বর জাহেলী যুগে কি নির্যাতনমূলক আচার-আচরণ ও দুর্ব্যবহার করা হতো তার লোমহর্ষক বিবরণ অজানা নেই কারো তার অবলুপ্তি ঘটিয়ে তাকে উচ্চমর্যাদায় আসীন করেছে। গাভীকে বাকশক্তি দান করে আল্লাহতায়ালা তার মুখ দিয়ে মায়ের মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বাকশক্তির অধিকারী, জ্ঞানসম্পন্ন মানুষকে।

ছেলেটি যখন গাভীটি নিয়ে তার মায়ের নিকট প্রত্যাবর্তন করে, তখন তার মা বলল, বেটা, তুমি দরিদ্র। তোমার কাছে টাকা-পয়সা ও অর্থ নেই। সারারাত জাগ্রত থাকা এবং দিনে কাঠ সংগ্রহ করা তোমার পক্ষে খুব কষ্টকর কাজ। তাই তুমি এ গাভী বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দাও। ছেলে তার মাকে জিজ্ঞাসা করলো, কত হলে বিক্রি করবো? মা বললো, তিন দিনারে বিক্রি করবে, তবে বিক্রি করার আগে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। আমার পরামর্শ ছাড়া বিক্রি করা যাবে না। তখনকার মূল্য অনুযায়ী গাভীটির মূল্য ছিল তিন দিনার। ছেলে গাভীটি বাজারে নিয়ে যায়।

তখন আল্লাহ তায়ালা একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন এ ছেলের পরীক্ষার জন্য। সে তার মায়ের অনুগত্য কতটুকু করে তা দেখাও আল্লাহর ইচ্ছা। ফেরেশতা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, গাভীটি কত দামে বিক্রি করবে? জবাবে সে বলল, তিন দিনার দামে বিক্রি করবে। তবে শর্ত হলো আমার মা যদি তাতে রাজি থাকেন। ফেরেশতা বললেন, আমি এর মূল্য তোমাকে ছয় দিনার দেব। শর্ত হলো, তোমার মায়ের সাথে পরামর্শ করতে পারবে না। ছেলে জবাবে বলল, তুমি যদি গাভীর শরীরের লোম পরিমাণও আমাকে তার মূল্য দিতে চাও আমি তা গ্রহণ করবো না, যতক্ষণ না আমার মায়ের সাথে পরামর্শ করবো। তার অনুমতি ছাড়া গাভী আমি বিক্রি করবো না।

অতঃপর ছেলে তার মায়ের কাছে গিয়ে জানায়, এক ব্যক্তি গাভীটির মূল্য ছয় দিনার দিতে চায়। মা বলল, আমার অনুমতিসহ ছয় দিনারে বিক্রি করে দাও। ছেলে গাভীটি নিয়ে আবার বাজারে যায়। ফেরেশতা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মায়ের সাথে পরামর্শ করেছ? ছেলে বলল, হ্যাঁ। জিজ্ঞাসা করেছি, মা বলেছেন যে, আমার অনুমতি ছাড়া ছয় দিনারের কমে বিক্রি করবে না। ফেরেশতা বললেন, আচ্ছা আমি তোমাকে এর মূল্য বারো দিনার প্রদান করবো। শর্ত হচ্ছে তোমার মায়ের অনুমতি নিতে পারবে না। ছেলে বলল, এটা কিছুতেই হতে পারে না। এ কথা বলে সে গাভীটি নিয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে এবং তার মাকে অবস্থা বর্ণনা করে। ছেলের বিবরণ শুনে মা বলল, বেটা! সম্ভবত: লোকটি মানুষের আকারে কোনো ফেরেশতা হবে এবং তোমার পরীক্ষা করতে চাইছে যে, তুমি মায়ের আনুগত্যে কতটুকু অটল আছ? এবার যদি সে তোমার কাছে আসে তাকে জিজ্ঞাসা করবে যে, আমাদের গাভীটি আমাদের বিক্রি করতে দেবে, নাকি দেবে না ?

সুতরাং ছেলে যায় এবং অনুরূপ বলে। এবার ফেরেশতা ছেলেকে বললেন যে, তোমার মাকে গিয়ে বলে দাও যে, গাভীটি এখন বেঁধে রাখতে এবং বিক্রি করার ইচ্ছা হতে আপাতত বিরত থাকতে। কেননা, হযরত মুসা (আ.)-কে একজন নিহত ব্যক্তির ব্যাপারে একটি গাভীর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তিনি এ গাভী খরিদ করবেন। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি এ গাভীর লোম (কেশ) পরিমাণ সোনা দেবেন না গাভীটি বিক্রি করবে না। তাই ফেরেশতার পরামর্শ অনুযায়ী তারা গাভীটি বেঁধে রাখে। আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে এবং মায়ের প্রতি ছেলের আনুগত্যের প্রতিদান হিসেবে অবিকল অনুরূপ গাভী জবাই করার জন্য নির্ধারণ করেন। সুতরাং বনি ইসরাইলকে যখন গাভী জবাই করার নির্দেশ প্রদান করা হয় তখন তারা বারবার তার গুণাবলী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে থাকে। তাই তাদের জন্য অবিকল ঐ গাভী নির্ধারিত হয়।

ঘটনা-২: 
অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, বনি ইসরাইলে একজন বৃদ্ধ লোক ছিল। তার একটি গো বাছুর ছিল। সে তা জঙ্গলে নিয়ে যায় এবং বলে, হে আল্লাহ! আমার ছেলে বড় হওয়া পর্যন্ত আমি এ বাছুর তোমার হেফাজতে দিচ্ছি। সুতরাং ছেলে বড় হয়, সে ছিল মায়ের অত্যন্ত অনুগত। গো বাছুরটিও জঙ্গলে বড় হয় এবং গাভী বয়সের হয়ে যায়। দেখতে খুবই আকর্ষণীয়, সুন্দর ও মোটাতাজা। বনি ইসরাইল ঐ এতিম ছেলে ও তার মায়ের কাছ থেকে তা সওদা করে এবং তার চামড়া সমান সোনা প্রদান করে। তখন ঐ গাভীর মূল্য তিন দিনার।

কোরআনে বনি ইসরাইলের অহেতুক-বেহুদা নানা প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ গাভী কোন বর্ণ ও গুণাবলী সম্পন্ন হতে হবে তার বর্ণনা দিয়েছেন। কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী, এ গাভীর সন্ধান পেতে তাদের চল্লিশটি বছর দারুণ হয়রানির মধ্যে থাকার পর সে গাভী অতি চড়া দামে মেলে এবং তা জবাই করে তার অংশবিশেষ দিয়ে নিহত ব্যক্তির দেহে আঘাত করার সাথে সাথে সে জীবিত হয়ে হত্যাকারীর নাম বলে দেয় এবং আবার মৃত্যুবরণ করে। কোরআনের এ বিখ্যাত ঘটনার কারণে বলা হয়ে থাকে যে, সূরাটির নাম করা হয়েছে বাকারা; শব্দটির অর্থ হচ্ছে গাভী।

গাভীটির রঙ-বর্ণ কি ছিল:

সে সম্পর্কে বর্ণনাকারী উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ বিদ্যমান। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, গাভীটির রঙ ছিল গভীর গাঢ় হলদে। হযরত কাতাদা (রা:)-এর মতে তা ছাফ, স্বচ্ছ, পরিষ্কার রঙের ছিল এবং হযরত ইমাম হাসান বসরী (রহ.)-এর মত অনুসারে গাভীটি হলদে ঈষৎ কালো রঙ বিশিষ্ট ছিল। তবে প্রথমোক্ত মত অধিক সঠিক বলে গণ্য করা, যা কোরআনে বর্ণিত রঙের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।লোকেরা যখন গাভীটি জবাই করে তখন আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশ আসে, জবাইকৃত গাভীর একটি অংশ দ্বারা নিহত ব্যক্তির দেহে আঘাত করতে। এ অংশ সম্পর্কেও মতভেদ রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) ও সকল ভাষ্যকারের মতে, সে অংশটি হাঁড় যা নরম হাঁড় নামে পরিচিত। যেমন নাক, কান ইত্যাদি, মোজাহেদ এবং সাঈদ ইবনে জুবায়ের প্রমুখের মতে, ঐ অংশটি ছিল লেজের মূল। কেননা সর্বপ্রথম লেজের মূলকে সৃষ্টি করা হয়। জেহাক বলেন, অংশটি জবান বা জিব। কেননা এটিই হচ্ছে বাকযন্ত্র। আকরানা ও কালবী বলেন, ডান রান দ্বারা আঘাত করা হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, কোনো নির্দিষ্ট অংশ ছিল না, লোকেরা জবাইকৃত গাভীর গোশত দ্বারা নিহত ব্যক্তির দেহে স্পর্শ করা মাত্র নিহত ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমে জীবিত হয়ে যায় এবং বলে দেয় যে, অমুক ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে। এতটুকু বলার পর সে মৃত হয়ে পড়ে যায়। সুতরাং তার হত্যাকারী কে তা জানা হয়ে যায়, বলা হয়ে থাকে, এ ঘটনার পর কোনো হত্যাকারী মিরাসের অধিকারী হয়নি।

এ ছাড়াও সুরা বাকারারা মধ্যে আরেকটি বাছুরের কথা উল্লেখ যোগ্য দিকঃ


ফেরাউনের অত্যাচার থেকে বনী ইসরাইল জাতি উদ্ধার পাবার পর ৩০ দিনের জন্য হযরত মূসা (আঃ)কে তুর পাহাড়ে যেতে হলো। সেখানে যে ৩০ দিনের জায়গায় ৪০ দিন হলো বনি ঈসরাঈলের এটা যানা ছিলন। তিনি গেলেন তওরাতের বাণী গ্রহণের জন্য। কিন্তু এই অল্প সময়েই বনী ইসরাইল জাতির জন্য এক বড় পরীক্ষা আসল। 


সামেরী নামের এক অতি ধূর্ত ব্যক্তি ছিল। যে মিশরে থাকা কালিন যাদুবিদ্যায় পারদর্শী ছিল ।জিনদের সাথেও তার বিশেষ সখ্যতা ছিল। মুসা আ: কতৃক সাগর দ্বিখন্ডিত করার সময়ে সে কিছু মাটি সংগ্রহ করে রেখেছিল।এদিনে বনি ইসরাঈলের কাছে থাকা সোনা যা মিশেরের মানুষের সেগুলো নিজেদের কাছে রাখার জন্য অনুতপ্ত বোধ করত। তাই তারা সোনাগুলো পুড়িয়ে ফেলল। সামেরী সেই গলিত স্বর্ন এক সাথে করে তারপর তার আগের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ও জিনদের একটি বাছুর বানাল। মুর্তিটি থেকে গরুর ডাক ভেসে আসত যেন তা জীবিত। সামেরী তখন জনগণকে স্বর্ণের তৈরী অদ্ভুত ওই মুর্তির উপাসনার দিকে আহ্বান জানায়।


প্রথমদিকে মানুষ যোগ পুজায় যোগ দেয় নি। কিন্তু সামেরী তাদেরকে এই বলে আশ্বস্থ করলো, মুসা আ: তার আল্লাহকে খুজে পাচ্ছেনা তার দেরী হচ্ছে। এদিকে আল্লাহ তো এখানে।এই বাছুরটাই তো ইলাহ। তারপর একাংশ মানুষ বাছুর পূজা শুরু করল। 


হারুন আ: তাদেরকে সতর্ক করেছিল কিন্তু তারা তার কথা শুনেনি বরং তার মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল। এবং তারা সাফ বলে দিল,মুসা না ফেলা পর্যন্ত তার পুজা থেকে ফিরে আসেব না । অবশ্য তুর পাহাড়ে থাক অবস্থায় মুসা আ: কে আল্লাহ জানিয়েছেন সমপ্রদায়ের বাছুর পুজার কথা। মুসা আ: ফিরে এসে স্বচক্ষে দেখে রেগে গেলেন। এবং এই বলে ভাই হারুনকে বকাঝকা করলেন যে সে হয়তো মানুষকে সতর্ক করেনি। কিন্তু হারুন আ: বললেন, হে আমার মায়ের পুত্র! লোকগুলো আমাকে দুর্বল মনে করল ও আমাকে মেরে ফেলার উপক্রম করল. . . . . আমাকে জালিমদের সারিতে গন্য করনা। (৭:১৫০)। হারুন আ: বুঝালেন যে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্ঠা করেছেন। তারপর মুসা আ: বুঝলেন এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন। 


মুসা আ: চাননি তাই সময় নিয়ে সবার কাছে জিজ্ঞাস করলেন। সবশেষে দাড়করালেন সামেরীকে। সামেরী ভাবলেষহীন ভাবে জানাল, সে যা দেখেছে অন্যরা তা দেখেনি। আর তার অন্তর থেকে এই কুমন্ত্রনা দিয়েছে। 


অবশেষে মুসা আ: সামেরীকে শাস্তি দিলেন এবং বল্লোন তার শাস্তি হবে এই যে, সে শুধু বলতে থাকবে আমাকে স্পর্শ করনা। সে আক্রান্ত হবে এক দুরারোরগ্য ব্যধিতে এবং মৃত্যু হবে শোচনীয় ও একাকি। (২০:৯৭)। মুসা আ: বাছুরটাকে আগুনে পুড়িয়ে ফেললেন যাতে তার প্রতি কোন সমবেদনা না থাকে।যারা প্রতক্ষ বা পরোক্ষভাবে পুজা করছে তাদের পুজা করারা শাস্তি হিসেবে নির্দেশনা ছিল, নিজ পরিবারের সদস্যরাই অভিযুক্তকে হত্যা করবে অর্থাত বাবা ভাইকে, ভাই ভাইকে, ছেলে বাবাকে। এভাবে প্রায় ৭০ হাজার বনি ঈসারাইলকে হত্যা করা হল ।

গো পূজারীদের প্রতি এ নির্দেশ কেন ?

বনি ইসরাইল ছিল গোপূজারী, গোভক্ত। হজরত মুসা (আ.) যখন তার ভাই হজরত হারুন (আ.)-কে প্রতিনিধি হিসেবে রেখে তুর পর্বতে গমন করেন তখন সামেরী একটি গোবাছুর বানিয়ে তার পূজা করার জন্য বনি ইসলাইলকে প্ররোচিত করেছিল। গাভীর হত্যাকে ওরা পাপ মনে করতে থাকে। বনি ইসলাইলের গোপ্রীতি, ভক্তি ও গোপূজার বর্ণনা তাদের তওরাত গ্রন্থেও দেখা যায়। সুরা বাকারায় বর্ণিত বনি ইসরাইলের নিহত ব্যক্তি আমিলের ঘটনা সম্পর্কে হত্যাকারী শনাক্ত করার ব্যাপারে গরু জবাইয়ের নির্দেশ ব্যাপক আলোচিত বিষয়।

এ প্রসঙ্গে মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদির বর্ণনাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তার বিখ্যাত তফসীরে মাজেদীতে তিনি লিখেছেন : (অনুবাদ : এটি ছিল সেই সময় যখন দীর্ঘকাল মিশরে ও মিশরবাসীদের মাঝে অবস্থানের কারণে তাওহীদের পতাকাবাহী ইসরাইলীদের মধ্যেও অনেক অংশবাদী রীতি-প্রথার প্রসার ঘটেছিল এবং গরুর মাহাত্ম্য ও তার পবিত্র হওয়ার ধ্যান-ধারণা তাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। ভারতের ন্যায় মিশরেও গোমাহাত্ম্য পৌত্তলিক (অংশীবাদী) ধর্মের অংশ বিশেষ ছিল। তাওরাতে ইহুদিদের প্রতি বিভিন্ন শর্ত ও বন্ধনযুক্ত গরু জবাইয়ের আদেশ বারবার প্রদান করা হয়েছে। যথা ইসরাইল সন্তানগণকে বলে, তারা নির্দোষ ও নিষ্কলঙ্ক জোয়াল বহন করে নাই এমন এক রক্তবর্ণা গাভী তোমার নিকট আনুক। পরে তোমরা ইলীয়াসার (আল-যাসার) যাযককে সে গাভী দেবে এবং সে তাকে শিবিরের বাইরে নিয়ে যাবে এবং তার সম্মুখে তাকে হনন করা হবে। গণনা পুস্তক (১৯:২, ৩)। যে নগরে নিহত লোকদের নিকটস্থ হবে, তথাকার পাল হতে এমন একটি গো-বৎসা নেবে যা দ্বারা কোনো কার্য হয়নি। যে জোয়াল বহন করেনি। পরে সেই গো-বৎসাকে এমন একটি উপত্যকায় আনবে, যেখানে চাষ বা বীজবপন করা হয় না, সে উপত্যকায় তার গ্রীবা ভেঙে ফেলবে (দ্বিতীয় বিবরণ ২১:৩, ৪) (তফসীরে মাজেদি পৃ. ১৩২)। তওরাতের উদ্ধৃত বিবরণ প্রমাণ করে যে, ইহুদীরা গো-পূজা করত এবং নিহত ব্যক্তির হত্যাকারী শনাক্ত করতে হলেও পরে বর্ণিত গুণাবলীর একটি গাভী হত্যা করত তাদের জাহেলী আকীদা বিশ্বাস অনুযায়ী।

ঘাটনার কারনে মাসালার উদ্ভব:



এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বহু গুরুত্বপূর্ণ মাসালার উদ্ভব হয়েছে। ফেকা শাস্ত্রের পরিভাষায় এরূপ ঘটনাকে আল কাসামাহ বলা হয়। যার অর্থ হচ্ছে, নিহত ব্যক্তির হত্যাকারী অজ্ঞাত থাকলে, তার নাম-পরিচয় জানা না গেলে ইসলামের এ সম্পর্কে কি বিধান ও বিষয়টি নিয়ে ফেকার কিতাবগুলোতে বিশদ বিবরণ রয়েছে। এর সংক্ষিপ্ত এই যে, অকুস্থলের আশপাশের তথা মহল্লাবাসীর সকলকে শপথ করে বলতে হবে যে, নিহতের হত্যাকারী সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। এরূপ খুনের ঘটনার ন্যায় গুম হয়ে যাওয়ার ঘটনারও একই হুকুম বা বিধান। খুনিকে শনাক্ত করা সম্ভব না হলে সকল অভিযুক্তের কাছ থেকে শপথ নিতে হবে বলেও মত রয়েছে।সূরা বাকারার সংশ্লিষ্ট ভাষ্য ও অন্যান্য গ্রন্থের বিবরণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছি। এসব গ্রন্থে গুরুত্বপূর্ণ আরো বহু সূ² বিষয় জানা যায় বনি ইসরাইলের গাভী জবাই সংক্রান্ত তরিকা বা প্রথার প্রাচীনত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে যারা নানা যুক্তির অবতারণা করেছেন মওলানা মোহাম্মদ হিফজুর রহমান সাহওয়ারভী (রা.) তা মানতে রাজি নন, তিনি এ মতকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি এ সম্পর্কে হাফেজ ইমাজদ্দীন ইবনে কামীরকে উদ্বুদ্ধ করে বলেন এবং ওবায়দা, আবুল আলিয়া এবং অন্যদের বর্ণিত ধারা বিবরণীগুলো পরস্পরবিরোধী এবং ছাফ সোজা কথা হচ্ছে এই যে, বনি ইসরাইলের গ্রন্থাবলী হতে গৃহীত এসব বর্ণনাকে স্বীকারও করি না, মিথ্যাও বলি না, যা নকল করা জায়েজ বটে। এ কারণে ওসব বর্ণনার ওপর নিশ্চিতরূপে আস্থাশীল হওয়া যায় না তবে সে সব বর্ণনা কোরআন ও হাদীসের আলোকে অধিক সঠিক, সত্য, সেগুলো আমাদের নিকট গ্রহণযোগ্য। তিনি আরো বলেন, যখন মুসলিমের হাদীসে মাত্র এতটুকু উল্লেখ আছে যে, বনি ইসরাইল যদি মুসা (আ.)-এর সাথে বাদানুবাদ না করত, তাহলে গাভীর ব্যাপারে তাদের প্রতি শর্তাবলী আরোপিত হতো না, তাহলে যদি এর চেয়ে অধিক অবস্থা ও ঘটনাবলিও তার সাথে সম্পৃক্ত হতো, তাহলে নবী মাসুম (স.) অবশ্যই তা উল্লেখ করতেন।

No comments:

Post a Comment

A BROKEN DREAM- chapter -one

A BROKEN DREAM Status of Rule of Law, Human Rights and Democracy Justice Surendra Kumar Sinha Chief Justice (Rtd.), Supreme Court ...